বরগুনার ব্যতিক্রমী চিকিৎসক
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর পাশাপাশি জ্বর- সর্দি বা শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বরগুনা জেলাতেই এখন বড় ভরসার নাম চিকিৎসক কামরুল আজাদ। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের ৫০ শয্যার আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) ওয়ার্ডের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা ৬১ জনকে এখন পর্যন্ত চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে ১০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

গতকাল শনিবারও হাসপাতালে কামরুল আজাদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২১ জন। তাঁদের মধ্যে ১০ জন করোনা রোগী। হাসপাতালের বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পদ শূন্য থাকায় তাঁকেই সামলাতে হচ্ছে করোনা রোগীদের। সারা দিন দায়িত্ব পালনের পর নতুন রোগী এলে রাত ১২টায়ও তাঁকে ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে। চীনফেরত এক শিক্ষার্থীর করোনা উপসর্গের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বরিশাল বিভাগে তিনিই প্রথম আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করেন। আর হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তিনি।
চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নিয়ম করা হয়েছে, কোনো চিকিৎসক সাত দিন আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দিলে তাঁকে পরের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে (সঙ্গনিরোধ) থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তব কারণেই এই নিয়ম চিকিৎসক কামরুল আজাদের (৪১) পক্ষে মেনে
চলা সম্ভব হচ্ছে না। গত ২৫ মার্চ থেকে তিনি এক দিনের জন্যও কোয়ারেন্টিনে যেতে পারেননি। পুরোটা সময় তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন।
শুধু চিকিৎসাই নয়; নিজের বেতনের টাকায় রোগীদের পুষ্টিকর খাবার কিনে দেওয়ার চেষ্টা করেন চিকিৎসক কামরুল। রোগীদের মানসিক শক্তি বাড়াতে তাঁদের কাউন্সেলিং (পরামর্শ) করান। হাসপাতাল চত্বরে নিজের অর্থে তাঁবু খাটিয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী ও সাধারণ রোগীদের বাছাই করার জন্য দুই কক্ষের একটি রোগী শনাক্তকরণ জোনও (বিভাগ) খুলেছেন তিনি। এ কাজে তাঁকে সহযোগিতা করছেন হাসপাতালের অন্য সহকর্মীরা।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন এফসিফিএস চিকিৎসক হয়েও কামরুল যেভাবে একটানা কাজ করছেন, সেটা সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয়। আমরা উনাকে বারবার বলি, আপনি সুস্থ থাকার জন্য বিশ্রাম নিন। তিনি বলেন, আমি বিশ্রামে গেলে এই রোগীদের কী হবে ? এই জেলায় প্রশিক্ষিত করোনা চিকিৎসক হিসেবে তিনিই একমাএ ভরসা। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করি ।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূএ জানায়, গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি জেনারেল হাসপাতালে করোনা ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ আসে। হাসপাতালে সে রকম অবকাঠামো ছিল না। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীনফেরত এক ছাত্র বরগুনায় আসেন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে। তখন করোনা চিকিৎসায় কোনো চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ছিল না। এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। তখন কামরুল এগিয়ে এলেন। হাসপাতালের সীমিত অবকাঠামোর মধ্যে ওই ছাত্রকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি ওই ছাত্রকে চিকিৎসাসেবা দেন। ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ওই ছাত্রের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনি তাঁকে ১৪ দিন এখানে রেখে চিকিৎসা দেন।
গত মার্চের মাঝামাঝি হাসপাতালের ২৫০ শয্যার নির্মাণাধীন নতুন ভবনে করোনা ইউনিট খোলা হলো। কিন্তু এই ভবনের দরজা-জানালা লাগানো ছাড়া আর সব কাজ বাকি ছিল। কামরুল নিজে এবং হাসপাতালের অন্যদের কাছ থেকে অর্থ তুলে সাজালেন করোনা ইউনিট। ১৯ মার্চ ঢাকায় এক দিনের করোনা প্রশিক্ষণের জন্য একজন চিকিৎসককে ডাকা হলো। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সব চিকিৎসককে নিয়ে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, চিকিৎসক কামরুলই প্রশিক্ষণে যাবেন।
চিকিৎসক কামরুল আজাদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। সাত বছর বয়সী একমাত্র ছেলে, স্ত্রী, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মা-বাবা ও ক্যানসার আক্রান্ত শাশুড়ি—সবার দেখভালের দায়িত্ব আমার। দেশের দুর্যোগে পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে মন সায় দিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া নিয়ে স্ত্রী নাইয়ার আফরিন ও প্রথমে কিছুটা নীরব ছিল। এরপর বলল, দেশের মানুষের টাকায় তুমি পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়েছ। এর বদৌলতে আমরা মর্যাদাপূর্ণ একটা জীবন পেয়েছি। দুর্দিনে তুমি তাদের পাশে থাকো। সংসার, সন্তান, পরিবার আমি নেব।’
বরগুনা জেলায় এখন পর্যন্ত করোনভাইরাইসের মারা গেছেন দুজন । মোট আক্রান্ত ৩০ জন । তাঁদের মধ্যে একজন চিকিৎসক।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এক রোগী মুঠোফোনে বললেন, ‘কামরুল স্যারকে দেখলে মনে সাহস পাই। তিনি ডাক্তারদের ব্যাপারে মানুষের প্রচলিত ধারণা বদলে দিয়েছেন।’